Feedjit Live

Monday, June 27, 2011

ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ


জাপানি অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে দারাদ আহমেদ (বাঁয়ে)
ফাইল ছবি
‘জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ করার নামে জাপানি এক অধ্যাপকের কাছ থেকে সাড়ে ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এক বাংলাদেশি। রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশপ্রেমী ওই জাপানি অধ্যাপক প্রতারণার এ ঘটনায় ভেঙে পড়েছেন।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার নামে প্রতারণা করেছেন দারাদ আহমেদ নামের এক বাংলাদেশি। নিজেকে তিনি রবীন্দ্রগবেষক ও বিশ্বভারতীর ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতেন। তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়।
জাপানের প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, অধ্যাপক কাযুও আজুমা জাপানে রবীন্দ্রগবেষক এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেমী হিসেবে পরিচিত। নিজের একক প্রচেষ্টায় জাপান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি কলকাতায় ‘ভারত-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ করেছেন। বিশ্বভারতীতে ‘নিপ্পন ভবন’ তৈরিতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। ভারতের এ দুই প্রতিষ্ঠান জাপান-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আজুমার স্ত্রী কেইকো আজুমাও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
কেইকো আজুমা কিছুদিন আগে প্রথম আলোর টোকিও কার্যালয়ে চিঠি লিখে প্রতারণার বিষয়টি জানিয়েছেন। কেইকো জানান, ২০০৩ সালে কলকাতা সফরের সময় তাঁর সঙ্গে পরিচিত হন দারাদ আহমেদ নামের এক বাংলাদেশি। তিনি নিজেকে বিশ্বভারতীর সংগীতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন, এর আগে কিছুদিন তিনি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়ও সাংবাদিকতা করেছেন। দারাদ দাবি করেন, তাঁর মা-ও একজন রবীন্দ্রভক্ত। পেশায় তিনি মস্তিষ্কের শল্যচিকিৎসক (সার্জন) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করেন। এ কারণেই পেশাগত দায়িত্বে তাঁকে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতে হয়।
কেইকো জানান, ভারতের মতো বাংলাদেশেও একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার ইচ্ছা তাঁদের ছিল। দারাদের এসব কথায় আজুমা ও তাঁর মনে হয়েছে, বাংলাদেশে তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে হলে এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি তো আর অন্য কেউ হতে পারে না। এদিকে কলকাতা থেকে জাপানে ফেরার পর দারাদ এ বিষয়ে অনেকগুলো চিঠি লেখেন। একপর্যায়ে দারাদের মা-ও চিঠি লিখতে থাকেন।
আজুমার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দারাদ ২০০৪ সালে জাপানে চলে আসেন এবং তাঁর চেয়ে ২০ বছরের বড় এক জাপানি রমণীকে বিয়ে করেন। আজুমার পরিবারের সহায়তায় তিনি জাপানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি জোগাড় করেন। একপর্যায়ে দারাদ তাঁকে ‘জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ করার পরামর্শ দেন। দারাদ বলেন, তিনি প্রকল্পের সব দেখভাল করবেন। আজুমাকে শুধু অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
কেইকো জানান, ‘দারাদ তাঁকে বিষয়টি গোপন রাখার এবং আর কোনো বাংলাদেশিকে এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত না করার অনুরোধ জানান। দারাদ তাঁকে বোঝান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি ঢাকা শহরে নয়, বরং রবীন্দ্রনাথের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করে মফস্বলের কোথাও তৈরি করা উচিত। আর তিনি যেহেতু সাইফুর রহমানের (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী) নিকটাত্মীয়, ফলে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় তাঁর নিজ গ্রাম হবে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির সবচেয়ে জুতসই জায়গা।
আজুমা জানান, দেশে ফিরে দারাদ ও তাঁর মা বিরামহীনভাবে অর্থের জন্য তাগিদ দিতে থাকেন। তিনিও টাকা দিতে থাকেন। একপর্যায়ে দারাদ ও তাঁর মা আজুমা দম্পতিকে আমন্ত্রণ জানান মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। সেখানে একটি ইটের ভাটায় একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপনের ছবিও তোলেন। এ সময় দারাদ জানান, আরও টাকা পেলে এই কেন্দ্র ভালো করে তৈরি করা যাবে। 
মোট কত টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে জাপানি এই দম্পতি জানান, সব মিলিয়ে জাপানের ৭৮ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাঁরা ছয় কোটি ৮০ লাখ জাপানি ইয়েন (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা) সংগ্রহ করেন। এর বাইরে দারাদ ও তাঁর মা তাছলিমা খানমের লিখিত আবদারের ভিত্তিতে অতিরিক্ত আরও অর্থসহ মোট ছয় কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার ইয়েন (প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা) দেওয়া হয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করার জন্য। কিন্তু দারাদ এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
বারবার চিঠি, বারবার টাকা দাবি: তাছলিমা খানম একটি চিঠিতে বলেন, ‘২০০৭ সালের ১০ থেকে ২০ মে পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ২০০৭ সালের আগস্টে আমরা ভবন উদ্বোধন করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাপানের সব সুযোগ-সুবিধা, লিফট, পার্কিং, বাগান, এয়ারকন্ডিশন, উন্নত বাথরুম থাকছে এখানে। আমরা প্রথম নকশা থেকে আরও বড় করেছি। আমি নিজে এই ভবন তৈরির জন্য তিন হাজার ৫০০ মান (এক মান মানে ১০ হাজার ইয়েন) খরচ করেছি। বর্তমানে আমার চাকরির বেতন দিয়ে চলতে পারছি না বিধায় আপনার সহায়তা কামনা করছি। আর দেড় হাজার ইয়েন হলে আগস্টে ভবনটি উদ্বোধন করা যাবে।’ চিঠিতে বলা হয়, এ বিষয়ে ১০ দিন ধরে বৈঠক হয়। এতে যোগ দেন তপন কুমার দেবনাথ, মুক্তাদির হোসেন, রিয়াজুল ইসলাম, তপন চৌধুরী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, কবির আনোয়ার প্রমুখ।
২০০৯ সালের ২০ আগস্ট আরেক চিঠিতে তাছলিমা লেখেন, ‘ভবনের চতুর্থ তলার কাজ শেষ হয়ে গেছে। বাকি রইল একতলা। খুব তাড়াতাড়ি কাজ করতে হচ্ছে। আমার চাকরির টাকায় কাজ করাচ্ছি। আপনাকে নিয়ে এই ভবন উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। ভবনে খুব দামি পাথর লাগানোর জন্য অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। আরও কিছু টাকা দরকার।’
২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাছলিমা আরেকটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, ‘আমি আবারও প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছি। আগামী বছরের জানুয়ারিতে ভবন উদ্বোধন করতে চাই। আপনাদের সাহায্য ছাড়া কাজ শেষ করতে পারছি না। খুবই মূল্যবান গ্লাস ও পাথর লাগানোর জন্য খুব বেশি খরচ হচ্ছে। আর মাত্র ৬০০ মান দেবেন। এরপর আর টাকা চাইব না।’
২০১০ সালের ২৮ জুন এক চিঠিতে বলা হয়, ‘দুই দিন আগে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আগামী মাসের ২৫ তারিখে ভবন উদ্বোধন করা হবে। এখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। টাকা লাগবে। আমি আমার গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ভবনের কাজ করছি। দয়া করে আর মাত্র ৩৬০ মান পাঠাবেন।’
২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর আরেক চিঠিতে বলা হয়, ‘টাকার অভাবে এখনো ভবনে নিরাপত্তা ক্যামেরা ও এয়ারকন্ডিশন লাগাতে পারিনি। সুখবর হলো, ভবন উদ্বোধন করা হলে সরকার টাকা দেবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। তাই আপাতত ধার হিসেবে ২০০ মান চাইছি। আগামী মাসে ভবন উদ্বোধন করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী আর আসবেন না। আমিও সরকারি চাকরি থেকে অবসরে চলে যাব। আপনার টাকার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।’
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভবন উদ্বোধনের একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় আজুমা দম্পতির কাছে। তাতে বলা হয়, ‘২৯ জানুয়ারি জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টারের শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা অনুষ্ঠানে গান গাইবেন। নৃত্য পরিবেশন করবেন শামীম আরা নীপা ও শিবলী মহম্মদ। আমন্ত্রণে দারাদ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক, জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টার ও তাছলিমা খানম, পরিচালক, জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টার।’
যেভাবে প্রতারণা ধরা পড়ে: বারবার টাকা পাঠানোর অনুরোধ করায় টাকা দিয়েছেন এমন কয়েকজন জাপানির মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাঁরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। তবে আজুমা সন্দেহ করেননি। কিন্তু বারবারই উদ্বোধনের তারিখ পেছানো হয়। একপর্যায়ে দারাদ যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তখন আজুমা দম্পতি বুঝতে পারেন, তাঁরা প্রতারণার শিকার।
বর্তমান অবস্থা: অধ্যাপক কাযুও আজুমা বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। বাংলা ভাষা ও বঙ্গভাষীদের কল্যাণে আজীবন নিজেকে নিবেদিত রেখে জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে এভাবে যে প্রতারণার শিকার হতে হবে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি।
কেইকো আজুমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী অধ্যাপক কাযুও আজুমা সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রচর্চায়। আমার স্বামী ও আমি বাঙালিদের ভীষণ ভালোবাসি। তাদের বিশ্বাস করি। দারাদ আহমেদকেও সেভাবে ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি। এর আগে বাঙালিদের নিয়ে কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি আমাদের। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যে এভাবে ঠকে যেতে হবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি।’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় অধ্যাপক আজুমা তাঁর দোভাষী হিসেবে কাজ করেন এবং সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। এ ছাড়া গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরের সময় তাঁর খোঁজখবর নেন। পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস সে সময় আজুমার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ফুলের তোড়া উপহার দেন।
কেইকো এখনো চান, ‘জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ বাস্তবায়িত হোক। তিনি ঘটনার বিচার দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমার স্বামীকে ভালো করে চেনেন। গত বছর তাঁর জাপান সফরের সময় তিনি আমার স্বামীর খোঁজখবর নিয়েছিলেন এবং ওর জন্য ফুল পাঠিয়েছিলেন। আমি তাঁর কাছে ঘটনার বিচার দাবি করছি।’
প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More