Feedjit Live

Monday, July 4, 2011

 দলিল জালিয়াতি ও তথ্য লোপাটের চক্র


ঢাকার ১০টি ভূমি সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে আমমোক্তারনামার নিবন্ধন নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ নিয়মিত ব্যাপার। জালিয়াতির কারণে মামলার সংখ্যাও অনেক। জালিয়াতির আরেক বড় ক্ষেত্র জেলার একমাত্র মহাফেজখানাটি।
নিবন্ধনের তথ্যপ্রমাণ থাকে মহাফেজখানায়। সুরক্ষা ও সংরক্ষণের অভাবে সেখান থেকে নিবন্ধনের তথ্য গায়েব হয়ে যাচ্ছে। দলিলের অবিকল নকল তোলা ও জমি কেনাবেচার সময় তথ্য যাচাই করতে মানুষ মহাফেজখানার দ্বারস্থ হয়। তখন ভোগান্তি ও খরচ লেগেই থাকে।
ভূমি নিবন্ধন দপ্তরের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলেন, এ চিত্র পুরো দেশেই এক রকম।
আমমোক্তারনামা দলিল জালিয়াতি: মূল মালিক অন্য কোনো ব্যক্তিকে জমির তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দলিল তৈরি করে থাকেন। বিদ্যমান আইন অনুসারে আমমোক্তারনামা দলিল তৈরি করতে কোনো ধরনের ছবি বা দালিলিক প্রমাণের প্রয়োজন হয় না।
সাব-রেজিস্ট্রাররা জানান, আইনগত এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঢাকার সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসগুলোতে ভুয়া আমমোক্তারনামা দলিল তৈরি হচ্ছে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এক উত্তরা সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসেই নয়টি ভুয়া আমমোক্তারনামা দলিল চিহ্নিত হয়েছে।
ভূমি নিবন্ধন অফিস ডিজিটালকরণ কমিটির পরামর্শক ও ভূমি নিবন্ধন অফিসের সাবেক পরিদর্শক নারায়ণচন্দ্র দাশ বলেন, আইনি দুর্বলতার সুযোগে সারা দেশে প্রচুর ভুয়া আমমোক্তারনামা দলিল তৈরি হচ্ছে। জালিয়াতেরা দখল করে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের জমি। অন্যের জমি দখল করে বহুতল ভবন বানাচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে হাজার হাজার মামলাও রয়েছে। তিনি আরও জানান, একজন সাব-রেজিস্ট্রার একবার ভুলভাবে কোনো জমি নিবন্ধন করলে তা শুধরানোর সুযোগ তাঁর নেই। এ নিয়েও সারা দেশে প্রচুর মামলা হচ্ছে।
অরক্ষিত মহাফেজখানা: সাধারণত জমি নিবন্ধন হয়ে থাকে সাব-রেজিস্ট্রারের কক্ষে। এরপর নিবন্ধনের তথ্য সংরক্ষণ করা হয় নিবন্ধন বইয়ে। যেকোনো নিবন্ধন বই এক বছর সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে থাকার পর তা সংরক্ষণের জন্য মহাফেজখানায় পাঠানো হয়। জমিজমাসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের ভরসা এই মহাফেজখানা।
ভূমি নিবন্ধন পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও ডিজিটালকরণ-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এই মহাফেজখানা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত নিবন্ধন বইগুলো বহু ব্যবহারে বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু, অপাঠ্য ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এ জন্য তল্লাশিতে সময় ব্যয় হচ্ছে এবং প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দলিলের তথ্য গায়েব: মহাফেজখানা সূত্র জানায়, তল্লাশি করতে গেলে মাঝেমধ্যেই সংরক্ষিত নিবন্ধন বইয়ের পাতা ছেঁড়া পাওয়া যায়। কর্মকর্তাদের ধারণা, জালিয়াত চক্র এসব করছে।
সম্প্রতি মহাফেজখানার ১৬৫ নম্বর নিবন্ধন বইয়ের ২৩১ থেকে ২৩৬ ও ১৩৯ থেকে ২৪৮ নম্বর পৃষ্ঠা এবং ১১৫ নম্বর বইয়ের ৫১ থেকে ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠা ছেঁড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। এরপর সাব-রেজিস্ট্রার জসিমউদ্দিন ভূঁইয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, কারওয়ান বাজারের ১২৮ নম্বর খতিয়ানের (সিএস দাগ ৯৪, ৯৫, ৯৬) ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ জমির মালিক একই এলাকার বাসিন্দা রাবিয়া খানম। খায়রুন্নেসা, ওয়াহিদা ইয়াসমীন, আবুল বাশার ও আবু তালেব মিয়া নামের চার ব্যক্তি নিজেদের এই জমির মালিক দাবি করে ভুয়া দলিল করেন। ভুয়া দলিলকে মূল দলিল হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মহাফেজখানায় সংরক্ষিত মূল দলিলের তথ্য নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
গত ১৬ মে ভুয়া দলিলধারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করা হয়েছে, যা বর্তমানে বিচারাধীন।
সম্প্রতি ১৯৭৭ সালের ১০ নম্বর নিবন্ধন বইয়ের ৯১ থেকে ৯৪ নম্বর পৃষ্ঠাও ছেঁড়া পাওয়া গেছে। গত ১৫ মে সাভারের জ্যেষ্ঠ সহকারী হাকিমের (দেওয়ানি মামলা ৫৯৫৭/২০০৮) আদালত থেকে এ নিবন্ধন বইটি তলব করা হয়। কিন্তু যে জমি নিয়ে মামলা, সে তথ্যসম্পর্কিত পৃষ্ঠাগুলো ছিল না। এ-সম্পর্কিত সূচিবইও নষ্ট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯ জুন জমির মালিকানা নির্ধারণের জন্য মহাফেজখানা থেকে এ-সম্পর্কিত টিপবইটি আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকা বড় লোভনীয়: গত ২১ জুন ঢাকার ভূমি নিবন্ধন অফিসের মহাফেজখানায় দলিলের নকল পাওয়ার নিশ্চয়তা না পেয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেন নুরুল ওহাব। তাঁর বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বাঙ্গালগাঁও গ্রামে। তিনি জানান, তাঁর বাবা মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ থেকে ’৭৬ সালের কোনো একসময়ে প্রায় এক বিঘা জমি কিনেছিলেন। সে সময়ে নিবন্ধন হলেও জমির নামজারি হয়নি।
সম্প্রতি তাঁর ঘর থেকে সেই জমির মূল দলিল চুরি হয়ে গেছে। এর পর থেকেই কিছু ব্যক্তি নিজেদের ওই জমির মালিক দাবি করে দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মহাফেজখানার তল্লাশিকারক সচিন্দ্র চন্দ্র সাহা জানান, ১৯৭৪ থেকে ’৭৬ সালের নিবন্ধনের সূচিবই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এর তথ্য খুঁজে বের করা দুরূহ কাজ।
গত ২৫ জানুয়ারি সাব-রেজিস্ট্রার দ্বীপক কুমার সরকারকে ঢাকার মহাফেজখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ঢাকা এবং এর আশপাশের জমির দাম লোভনীয় বলেই ঢাকার মহাফেজখানাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু জালিয়াত চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মূলত মহাফেজখানাটি দীর্ঘ সময় অরক্ষিত থাকায় এই চক্রটি জাল দলিল করে মহাফেজখানা থেকে মূল দলিল গায়েবের কাজটি করে যাচ্ছে।
মহাফেজখানাতেও মধ্যস্বত্বভোগী! মহাফেজখানাকে কেন্দ্র করে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। মহাফেজখানা থেকে দলিলের তথ্য খুঁজে বের করেন তল্লাশিকারকেরা। নকলনবিশেরা সেটার নকল তৈরি করেন। জেলা অফিসের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৩০ হাজার ২৫৭টি দলিলের নকল সরবরাহ হয়েছে। এ হিসাবে ১০টি অফিস থেকে প্রতিদিন ২০০টির বেশি দলিলের নকল সরবরাহ হয়ে থাকে।
কিন্তু সরকারি ফির বাইরে সাধারণত দুই হাজার টাকার নিচে ঢাকার মহাফেজখানার তল্লাশিকারকেরা নিবন্ধন বইয়ে হাত দেন না। কলম খোলেন না নকলনবিশও। অথচ জমি নিবন্ধনের তথ্য তল্লাশির জন্য সরকারি ফি প্রতিবছরের জন্য ১০ টাকা, সর্বোচ্চ ৮০ টাকা। তল্লাশিকারকের প্রতিদিনের ফি তিন টাকা। দলিলের নকলের জন্য সরকারি ফি প্রতি ৩০০ শব্দে নয় টাকা এবং নকল লেখার জন্য নকলনবিশের সরকার-নির্ধারিত ফি প্রতি পাতা ১৫ টাকা।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা আসিফুর রহমান তমাল (২২) জানান, তিনি ১৯৯৬ সালের একটি দলিলের নকল তুলেছেন পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে। তল্লাশিকারক রুবেল মিয়া ১৯৬৩ সালের একটি দলিলের (নম্বর ৪৮৮৩) নকল সরবরাহের জন্য এই প্রতিবেদকের কাছে দুই হাজার টাকা দাবি করেন।
যবে হবে, তবে ঘুচবে: ভূমি নিবন্ধন অফিসের দুর্ভোগ সম্পর্কে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, যুগোপযোগী আইনের অভাবে ভূমি নিবন্ধন অফিসে অব্যাহতভাবে জনদুর্ভোগ, দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতি ঘটনা ঘটে থাকে। সবচেয়ে বেশি ত্রুটিপূর্ণ হলো আমমোক্তারনামা আইন। যে কারণে সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা এবং ছবি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হবে।
আইনমন্ত্রী আরও জানান, ভূমি নিবন্ধনের জটিলতা দূর করতে নিবন্ধন-পদ্ধতি ডিজিটাল করার বিকল্প নেই। এ জন্য ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সূচি, মূল নিবন্ধন বই ও টিপবইয়ের প্রতিচ্ছবি (স্ক্যান করা কপি) ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হবে। দলিলের ফরম অনলাইনে পাওয়া যাবে। ক্রেতা নিজেই সেই দলিল লিখতে পারবেন। এ জন্য কোনো দলিল লেখকের প্রয়োজন হবে না।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More