চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজার চরম অস্থির থাকার পর গতকাল রোববার ব্যবসায়ীদের নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সকালে বৈঠক করেছে ট্যারিফ কমিশন। বিকেলে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া হাইকোর্ট গতকাল চিনি ও সয়াবিন তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মজুদদারির বিরুদ্ধে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে সাতজন ডিও ব্যবসায়ীর নামে মামলা করার সুপারিশ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত গতকালের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘আপনারা তো এক মাস আগেই কথা দিয়ে গেলেন যে রমজানে পণ্যমূল্য বাড়াবেন না। হঠা ৎ চিনির দাম বাড়িয়ে দিলেন কেন?’ জবাবে ব্যবসায়ীরা কারখানা বন্ধ থাকাসহ তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, কিছু সমস্যার কারণে চিনির ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হলেও তা কেটে গেছে। রমজানেও পণ্যমূল্য আর বাড়বে না।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে চিনি ও ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা মালিকদের পাশাপাশি চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের জানান, ‘ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ভোজ্যতেল ও চিনির কোনো সংকট নেই, আগামী দিনেও কোনো সংকট থাকবে না। শুধু ঢাকায় চিনির ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহের একটু সমস্যা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এ রকম হবে না।’
ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ডিলার ও পরিবেশক পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। যে এলাকায় পরিবেশক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এর বাইরে অন্য এলাকায় পণ্য বিতরণ করা যায় না। এ বিষয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরিবেশকেরা নিজ এলাকায় পণ্য সরবরাহ করে উদ্বৃত্ত পণ্য অন্য এলাকায়ও সরবরাহ করতে পারবেন।’
যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে চারটি চিনি পরিশোধন কারখানা বন্ধ থাকা, হরতাল ইত্যাদি কারণ তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ীরা। তিনি আরও বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এখনো চান না পরিবেশক পদ্ধতিটি হোক। কিন্তু এটি করা হবেই।
আবদুল মোনেম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, চিনির দর কাল থেকেই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মিলগেটে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা দরেই চিনি সরবরাহ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীকে এ কথা জানিয়ে এসেছেন তাঁরা।
ডিও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ: বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে সাতজন ডিও ব্যবসায়ীর নামে মামলা করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া দেশের সব ভোজ্যতেল ও চিনি পরিশোধন কারখানা মালিকদের পরিবেশক পদ্ধতি পরিপূর্ণভাবে চালুর জন্য আবারও নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
নির্দেশে বলা হয়েছে, পণ্য বিপণন আদেশ ২০১১ অনুযায়ী ডিও প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চিনি ও ভোজ্যতেল বর্তমানে শুধু পরিবেশক নিয়োগের মাধ্যমেই বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। তিন মাসের সময় দিয়ে আদেশ জারি করা হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০ জুন। ডিও প্রথা বিলুপ্তির আগে অনেকে যেসব ডিও ইস্যু করেছিল, সে পণ্যও পরিবেশকের মাধ্যমেই বিক্রি করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে এই মুহূর্তে চিনির মজুদ রয়েছে এক লাখ দুই হাজার টন। আরও দুই লাখ ৩৭ হাজার টন চিনি দেশে এসে পৌঁছাবে রমজানের মধ্যে। অন্যদিকে, ভোজ্যতেলের মজুদ এক লাখ ৩১ হাজার টন। আর, দেশে এসে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও তিন লাখ ৩৭ হাজার টন।
ট্যারিফ কমিশনে বৈঠক: চিনির দর, সরবরাহের সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিবেশক পদ্ধতি চালুর বিষয়ে পরিশোধন কারখানা মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গতকাল নিজস্ব কার্যালয়ে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন।
বৈঠক শেষে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, সরকার-নির্ধারিত ৬৫ টাকা কেজি দরেই চিনি বিক্রি করতে হবে। গত কয়েক দিন কারখানার মালিকেরা রাজধানীতে কম সরবরাহ করে বেশি সরবরাহ করেছেন রাজধানীর বাইরে। তাই চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, চালান প্রথা (ডিও) থেকে পরিবেশক পদ্ধতিতে উত্তরণের প্রক্রিয়াতে কিছু সময় লাগছে। এ পদ্ধতি চালুর ব্যাপারে কোনো কোনো ব্যবসায়ীর অনীহা রয়েছে। ফলে এক ধরনের অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। দর বাড়ার পেছনে এটাও একটা কারণ বলে জানান তিনি।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, পরিশোধন কারখানা থেকে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল। এখন সরবরাহ ঠিক হয়েছে। সোমবার থেকেই পাইকারি বাজারে তাঁরা নির্ধারিত দর অর্থা ৎ ৬২ থেকে ৬৩ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করবেন।
সরবরাহের নানা আশ্বাস: এদিকে, দেশে চিনির মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।
গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বিএসএফআইসির পক্ষে শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সংস্থার গুদামে বর্তমানে ৫০ হাজার টন চিনি মজুদ রয়েছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে বিএসএফআইসির নির্ধারিত ডিলারদের মধ্যে ১০ হাজার টন চিনি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, চলতি মাসে দেওয়া হবে আরও ১০ হাজার টন।
সংস্থাটি জানিয়েছে, ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ২০ হাজার টন চিনি জাহাজীকরণের কাজ শেষ হয়েছে। শিগগির এ চিনি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছাবে। এ ছাড়া স্থানীয় বাজার থেকেও কেনা হবে ২০ হাজার টন চিনি। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় বাজার থেকে কেনা পাঁচ হাজার ৮১৩ টন চিনি এরই মধ্যে বিএসএফআইসির গুদামে গুদামজাত করা হয়েছে।
এদিকে, দেশবন্ধু চিনিকল কর্তৃপক্ষ গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুলভ মূল্যে চিনি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে তারা। প্রতি কেজি ৬৫ টাকা করে পরিবেশকদের মাধ্যমে মৌলভীবাজার, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, রামপুরায় চিনি বিক্রি করা হবে।
চার কর্মকর্তা তলব: চিনি ও সয়াবিন তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মজুদদারির বিরুদ্ধে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই দুটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ভূমিকা জানাতে টিসিবির চেয়ারম্যানসহ চার কর্মকর্তাকে তলব করা হয়েছে।
গতকাল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ সম্পূরক এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।
জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ নভেম্বর আদালত রুল জারি করেন ও অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা দেন। এরপর ওই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নিষ্ক্রিয়তা ও আদালতের নির্দেশনা অনুসারে প্রতিবেদন দাখিল না করায় এ নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গতকাল সম্পূরক আবেদনটি করা হয়।
আদালতের নির্দেশনায় সরকার-নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে কেউ যেন সয়াবিন তেল ও চিনি বিক্রি করতে না পারে, সে জন্য সাধারণ ও পাইকারি বাজারগুলো তদারক করতে বাণিজ্য ও খাদ্যসচিব এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তা ৎ ক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিতের কথাও রয়েছে নির্দেশনায়। অবৈধভাবে মজুদ করে কেউ যেন বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারেন, এ বিষয়টি তদারক করতেও বলা হয়েছে। এ ছাড়া টিসিবির চেয়ারম্যান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক (আমদানি-রপ্তানি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ৯ আগস্ট হাজির হতে বলা হয়। প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment