Feedjit Live

Sunday, July 10, 2011

 নতুন-পুরোনো বরাদ্দের চক্রে এডিপি

রেলওয়ে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ হতে পারে এডিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত রেলওয়ে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ হতে পারে এডিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নিয়ে নানা ধরনের ফাঁকফোকর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। বছর বছর এডিপির আকার বাড়ানো হয়। বড় আকারের এডিপি গ্রহণ করে ক্ষমতাসীনেরা বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাড়ছে। আর আমলারা বলেন, এডিপি বাস্তবায়নে সক্ষমতা বেড়েছে।
আবার প্রতিবছর রাজনৈতিক বিবেচনায় বছরের শেষদিকে নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে পরবর্তী বছরের এডিপিতে নতুন প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে হিমশিম খেতে হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ কমে আসে।
আবার বরাদ্দ কম দিয়ে নতুন প্রকল্প নিতে হয় বিভিন্ন পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে। এতে করে চলমান পুরোনো প্রকল্পেও পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া যায় না। ফলে বছর শেষে সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা কমে যায়, মেয়াদ বাড়িয়ে আবারও বরাদ্দ দেওয়া সেসব প্রকল্পে। এভাবে প্রকল্প চলে বছরের বছরের পর। এক ধরনের চক্রের মধ্যে পড়ে যায় পুরো এডিপি ব্যবস্থাপনা।
এ নিয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
সদ্য বিদায়ী ২০১০-১১ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আকার কমিয়ে ৩৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু বছরের মাঝখানে নতুন প্রকল্প ঢুকেছে ২৭০টি। আর এসব নতুন প্রকল্প পুরোনো চলমান প্রকল্প হিসেবে দেখিয়ে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৪৬ হাজার কোটি টাকার নতুন এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা ১০৩৯। এর মধ্যে ‘নতুন’ প্রকল্প মাত্র ৭৭টি।
এভাবে প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করাকে ‘চালাকি’ ও ‘অর্থের অপচয়’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পরিচালক জায়েদ বখত। তিনি আরও বলেন, ‘নতুন প্রকল্পগুলো মূলত মন্ত্রী-এমপিদের চাপে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়। বছরের শেষদিকে এসে নেওয়া এসব প্রকল্পে তাড়াহুড়া করে অর্থ খরচ করতে গিয়ে কাজের গুণগত মান থাকে না, এটা অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।’
এভাবে বছরের পর বছর নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার ফলে সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা তুলনামূলক কমছে। এসব ‘নতুন’ প্রকল্পে প্রতিবছর বরাদ্দ দিতে গিয়ে পুরোনো প্রকল্প সময়মতো শেষ করা যাচ্ছে না। মেয়াদ বাড়িয়ে পুরোনো প্রকল্পগুলোতে আবার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের একটি চক্রের মধ্যে পড়েছে এডিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
আবার ঢাউস আকারের এডিপির বাস্তবতা হলো, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে মূল্য সমন্বয়। এই মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। তাতে গুণগত কোনো পরিবর্তন হয় না।
এডিপির এই বিশৃঙ্খল অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জায়েদ বখত প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্য সংশোধনের বা সমন্বয়ের কারণে এডিপির আকার বাড়ে এটা সত্য। তবে প্রকৃত মূল্যেও এডিপির আকার বাড়ছে। এখানে সমস্যা হলো, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় এডিপির আকার কমে এসেছে। এর মানে হলো, প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে। আর সরকারি ব্যয় কম হলে বেসরকারি বিনিয়োগও তুলনামূলক কম আকৃষ্ট হবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরের ২৯ মে পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে যেসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী সেগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা চলতি অর্থবছরের এডিপির জন্য ৬৯ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু অর্থসংকটে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে জানান, প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে স্বভাবতই প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে।
ব্যয় বৃদ্ধির নমুনা: টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত ডবল রেলপথ নির্মাণে খরচ করা হবে দুই হাজার ৩৭ কোটি টাকা। আর ২০০৬ সালে একই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৭২০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে।
নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শুরু করতে না পারায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। গত ২০ জুন ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প আবারও অনুমোদন দেওয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক)।
অনুমোদনের পর এ বিষয়ে পরিকল্পনাসচিব মনজুর হোসেন বলেছেন, ‘যখন প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়, তখন জিনিসপত্রের দাম অনেক কম ছিল। দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অনেক সময় লেগেছে। ততক্ষণে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়েছে। জমি অধিগ্রহণেও আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হবে।’ প্রকল্পটির মেয়াদকাল বাড়িয়ে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে।
এমন আরেকটি প্রকল্প হলো খুলনা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান নির্মাণ প্রকল্প। গত ২২ মার্চ একনেকে এক হাজার ৫৪২ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ২০০৬ সালে যখন প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদন করা হয়, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০৩ কোটি টাকা।
সমস্যা হলো, দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক অনুমোদন পেতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ বছর। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির জন্য আনুষঙ্গিক সব নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। ফলে ২০১১ সালে প্রকল্প বাস্তবায়ন নতুন করে ব্যয় নির্ধারণ করতে হয়েছে।
দুটি প্রকল্পই ২০০৬ সালে বাস্তবায়ন শুরু হলে ব্যয় বর্তমানের অর্ধেকেরও কম হতো। কিন্তু ২০১১ সালে এসে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বড় হচ্ছে। দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নেই ব্যয় বাড়ানো হয়েছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে।
এদিকে গত পাঁচ বছরে এডিপির আকারও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২৬ হাজার কোটি টাকা, পরে সংশোধন করে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০০১১-১২ অর্থবছরে মূল এডিপির আয়তন ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে এডিপির আকার কমবেশি দ্বিগুণ হয়েছে।
মূলত এডিপির প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার এক ধরনের কেনাকাটা করে। পাঁচ বছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ করে পূর্ত কাজের মূল উপাদান ইট, বালু, সিমেন্ট, রডসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। বর্তমানে এক ট্রাক ইটের দাম ১৮-২০ হাজার টাকা। পাঁচ বছর আগে এক ট্রাক ইটের দাম ছিল ১২-১৩ হাজার টাকা। রডের দাম আলোচ্য সময়ে ওঠানামা করেছে। খুচরা পর্যায়ে এখন ভালোমানের এক টন রডের দাম ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। পাঁচ বছর আগে এর দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। উল্লেখযোগ্য হারে সিমেন্টের দামও বেড়েছে।
অথচ বিভিন্ন আমলের সরকার প্রতিবারই বড় এডিপি করে বাহবা নেয়। মন্ত্রী-এমপিরা চিৎকার করে গলা ফাটান উন্নয়নের জোয়ারে দেশকে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য। আর আমলারা দাবি করেন, ব্যয়ের সক্ষমতা বেড়েছে।
বাস্তবতা হলো, মূল্য সমন্বয়ের জন্যই এডিপির আকার বড় করতে হয়। পাঁচ বছর আগে সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকার এডিপিভুক্ত একই প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন করতে ৪৫-৪৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। ঠিকাদারও বর্ধিত মূল্য ধরেই দরপত্র জমা দেন।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণেও নানা জটিলতা রয়েছে। প্রকল্পের জন্য কোনো এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেই সেখানে জমির দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। এমনকি রাতারাতি কৃষিজমিতে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসতভিটা দেখানো হয়। ভূমি অধিগ্রহণকালে ক্ষতিপূরণ বাবদ অনেক বেশি অর্থ প্রাক্কলন করতে হয়।
এ সম্পর্কে মূল্যায়ন, পরিবীক্ষণ ও বাস্তবায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘একটি প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবনা তৈরির সময় ভূমির যে দাম নির্ধারণ করা হয়, অধিগ্রহণকালে তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর অন্যতম উদাহরণ হলো, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প।’
জিডিপি-এডিপি অনুপাত: মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এডিপির আকার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে না। চলতি মূল্যে হিসাব করে পাঁচ বছর আগে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে জিডিপির ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশই সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই অনুপাত ৩ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
এভাবে সরকারি বিনিয়োগ কম হলে সরকার যে অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়, তাও সেভাবে বাড়বে না। অথচ এই অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়েই বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা উৎপাদন বাড়ান, যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করে।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More