Feedjit Live

Monday, July 4, 2011

হয়রানি, ঘুষ আর দলিলজট

ঢাকা মহানগরের ১০টি ভূমি নিবন্ধন অফিসে মাসে গড়ে ১১ হাজারের কাছাকাছি দলিল নিবন্ধন করাচ্ছেন ক্রেতা-বিক্রেতা ও জমির মালিকেরা। নিবন্ধনকারী অর্থাৎ সাব-রেজিস্ট্রার অবধি পৌঁছাতে তাঁরা দলিল লেখক ও নানা ধাপের দালালদের কাছে জিম্মি।
নিবন্ধনের পর পাকা দলিল হাতে পেতে ঘুরতে হচ্ছে বছরের পর বছর। আটটি অফিসে এখন জমে আছে অন্তত এক লাখ ৩৮ হাজার দলিল তৈরির কাজ। ছয় মাস ধরে নিবন্ধন বই বা বালামের (ভলিউম) সরবরাহ নেই। নেই নিবন্ধন ফি আদায়ের পাকা রসিদ।
ঢাকা মহানগর দেশের ভূমি অফিসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করে। অথচ যাঁরা এই রাজস্বের জোগান দেন, প্রতিটি ধাপে তাঁদের পাওনা হয়রানির পাশাপাশি উপরি খরচ।
জেলা রেজিস্ট্রার সুভাষ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে জানি, ঘুষ ছাড়া ভূমি নিবন্ধন অফিসে কোনো কাজ হয় না। কিন্তু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।’ তাঁর মতে, যত দিন পর্যন্ত দাতা ও গ্রহীতা স্বহস্তে দলিল না লিখতে পারবেন, তত দিন দলিল লেখক বা দালাল নামের মধ্যস্বত্বভোগীরা ফায়দা লুটবে। মানুষের হয়রানি চলতে থাকবে। তিনি বলেন, দেশজুড়ে ভূমি নিবন্ধন অফিসের চিত্র এ রকমই।
তথ্যসংকট দিয়ে দুর্ভোগের শুরু: জেলা নিবন্ধন অফিসের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে ঢাকার ১০টি সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে এক লাখ ৩০ হাজার ২৭০টি দলিল নিবন্ধন হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ৩১ হাজার ৭১টি দলিল। এই হিসাবে প্রতি অফিসে মাসে গড়ে এক হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের দলিল নিবন্ধন হয়। একই হারে দলিলের নকলও সরবরাহ করা হয়।
জেলা অফিসের হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আয় হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এটা সারা দেশের মোট ভূমি নিবন্ধন রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ। অথচ রাজস্বের জোগানদাতা ক্রেতা-বিক্রেতারা কোথায় গেলে কী সেবা পাবেন, আইন কী বলছে—এসব জানানোর ব্যবস্থা অফিসগুলোয় নেই।
তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক, কিন্তু তেজগাঁওয়ের জেলা ভূমি নিবন্ধকের দপ্তরে কোনো তথ্য কর্মকর্তা পর্যন্ত নেই। নেই তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানানোর কোনো জায়গা।
হয়রানি ও উপরি খরচ: দশ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দুটি মিরপুর ও ডেমরায়। বাকি আটটি ঢাকা সদর, তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর ও উত্তরার সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিস তেজগাঁওয়ের জেলা নিবন্ধন দপ্তরের চত্বরে। সেখানে ১২ জুন দুপুরে কামরাঙ্গীরচরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম জানান, কোনো তথ্যকেন্দ্র না থাকায় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা না পাওয়ায় তিনি একজন দলিল লেখকের শরণাপন্ন হয়েছেন।
দলিল লেখকের ভূমিকা অনেকটা উকিলের মতো। ক্রেতা-বিক্রেতা চাইলে এঁদের কাছ থেকে আইনি ও দালিলিক সহায়তা নিতে পারেন। কিন্তু কার্যত অফিসের আঙিনায় পা দেওয়া মাত্র দলিল লেখক, তাঁদের সহকারী ও দালালেরা ক্রেতা-বিক্রেতাদের ছেঁকে ধরেন। এঁদের এড়িয়ে কেনাবেচার কাজ করা প্রায় অসম্ভব। এরপর নিবন্ধন অফিসের প্রধান কেরানি, অধস্তন কেরানি, পিয়ন, মোহরার, টিপসহি নেওয়া কর্মচারী এবং সাব-রেজিস্ট্রারের পাশে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা রাতের পাহারাদার তথা নাইটগার্ডদের খুশি না করে সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ মেলে না।
তেজগাঁও থানার সাব-রেজিস্ট্রার আবুল কালাম আজাদ বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই মানুষের হয়রানি। অন্যদিকে দলিল লেখকেরা দোষ চাপান সাব-রেজিস্ট্রারদের ওপর।
সাব-রেজিস্ট্রারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ১৯০৮ সালের ভূমি নিবন্ধন আইনে ৬৩ ধরনের ভূমি নিবন্ধনের কথা বলা আছে। এর মধ্যে বেশি হয় চারটি—কবলা বা হস্তান্তর, হেবা, হেবার ঘোষণা ও দানপত্র। কবলার সরকারি ফি বিভিন্ন খাত মিলিয়ে জমির সরকারিভাবে নির্ধারিত মোট দামের নয় শতাংশ। এর জন্য জমির মালিকানার কাগজ, পরচা, নামজারি, দাখিলা বা খাজনা রসিদ ও ভূমি উন্নয়ন করের রসিদ লাগে।
দলিল লেখকদের অভিযোগ, এসব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রতিটি নিবন্ধনের ক্ষেত্রেই সাব-রেজিস্ট্রারদের ঘুষ দিতে হয়। সরকারি হিসাবে জমির দাম কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা ঘুষের অন্যতম কারণ। জমির প্রকৃত দামভেদে ঘুষের পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দলিল লেখক সমিতির মহাসচিব এম এ রশিদ বলেন, সাব-রেজিস্ট্রাররা তাঁদের নাইটগার্ড বা পিয়নদের মাধ্যমে ঘুষ দাবি করেন।
মগবাজারের (৩৪৬ নয়াটোলা) আবুল কাসেম (৬৫) ঢাকা সদর অফিসে গিয়েছিলেন আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) অর্থাৎ নিজের অনুপস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ককে ক্ষমতা দেওয়ার দলিল করতে। ১৭ মে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাব-রেজিস্ট্রার রুহুল ইসলাম তাঁর নাইটগার্ড রানার মাধ্যমে তাঁর কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছেন। ঢাকা সদরের এই সাব-রেজিস্ট্রার নিবন্ধনের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) মুন্সী নজরুল ইসলামের ভাতিজা।
দলিল লেখক মাহবুব হোসেন অভিযোগ করেছেন, রুহুল ইসলামের দপ্তরে তাঁর একই রকম অভিজ্ঞতা হয়। এরপর দলিল লেখক সমিতি রুহুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইজিআরের কাছে লিখিত অভিযোগ জানায়। গত ২৯ মে আইজিআর রুহুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য জেলা রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে রুহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের যথাযথ উত্তর আমি লিখিতভাবে জেলা রেজিস্ট্রারকে জানিয়েছি।’
দলিল লেখক আখতারুজ্জামান বলেন, ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়ার অভিযোগে তিনি বাড্ডার সাব-রেজিস্ট্রার জসিমউদ্দিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। একই বিষয়ে তিনি দুদকেও অভিযোগ করেছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে জসিমউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি জমি রেজিস্ট্রেশনের আগ পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে দালাল বা দলিল লেখকদের কী অঙ্কের টাকা বিনিময় হয়, সেই তথ্য জানার সুযোগ আমার নেই। যদি লেনদেন হয়েও থাকে, সেই দায় সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে আমাকেই বহন করতে হবে।’
দলিল লেখকদের ফাঁদে: গত ১৫ জুন মহাখালী ডিওএইচএসের বাসিন্দা ফরিদ আক্তার একটি দলিল লেখার জন্য এক দলিল লেখককে তিন হাজার টাকা দেন। তিনি জানান, আশপাশের দালাল এবং নিবন্ধন অফিসের কর্মচারীরাও তাঁর কাছ থেকে টাকা খসিয়েছেন।
আইন অনুযায়ী একটি দলিল লিখে দেওয়ার জন্য লেখককে ৬৯ টাকা দিতে হয়। কিন্তু দলিল লেখকেরা একটি দলিল লিখে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাঁচ-ছয় হাজার এবং ব্যক্তি পর্যায়ে দুই-তিন হাজার টাকা করে নিয়ে থাকেন। তেজগাঁও দলিল লেখক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম বলেন, ৬৯ টাকায় দলিল লিখে দিলে কারও সংসার চলবে না।
রসিদ ও নিবন্ধন বই নেই: সাব-রেজিস্ট্রারেরা জানান, বর্তমানে এই দশ দপ্তরে জমি নিবন্ধন ফি আদায়ের রসিদ বই নেই। তাঁরা সাদা কাগজে সিল-স্বাক্ষর দিয়ে তা জমির মালিকদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। সরকারের ছাপাখানা (বিজি প্রেস) থেকে সর্বশেষ রসিদ বই সরবরাহ করা হয়েছিল ২০১০ সালের আগস্টে।
নেই নিবন্ধন বই। ফলে নিবন্ধনের পর জমির দলিল হাতে পাওয়া আরেক সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। জেলা নিবন্ধন অফিস সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি এক লাখ নিবন্ধন বই ছাপা হয়েছিল। এসব বই ফুরিয়ে গেছে প্রায় ছয় মাস আগে। যে কারণে নিবন্ধন বইয়ে তথ্য সংরক্ষণ এবং দলিল সরবরাহের কাজ পিছিয়ে পড়ছে। এক বছর ধরে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও বিজি প্রেস নিবন্ধন বই সরবরাহ করছে না।
এক লাখ ৩৮ হাজার দলিলের জট: গত ১৩ জুন গুলশান সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে ১৪টি দলিল সরবরাহ করা হয়েছে। সূত্র বলছে, এসব দলিলের একটি ২০০৫ সালে, ১২টি ২০০৬ সালে এবং একটি ২০০৭ সালে নিবন্ধিত হয়েছিল।
জেলা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের আটটি সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিসে বর্তমানে এক লাখ ৩৮ হাজার দলিল তৈরির কাজ ঝুলে আছে। এক গুলশান অফিসেই জমে আছে ৪৪ হাজার ৫০০ দলিল তৈরির কাজ। মোহাম্মদপুর অফিসে রয়েছে ২৭ হাজার, বাড্ডায় ২৩ হাজার ৩০০, উত্তরায় ২০ হাজার ৫৩৬, ঢাকা সদরে ১০ হাজার ৭২৮, সূত্রাপুরে নয় হাজার ৮৫৫ এবং খিলগাঁওয়ে দুই হাজার ৮৬১। সবচেয়ে কম ১৭৯টি দলিল লেখার কাজ অসমাপ্ত আছে তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিসে। মিরপুর ও ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিসের এ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের ভূমি নিবন্ধন পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও ডিজিটালকরণের লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যমান পদ্ধতির কারণে জমি নিবন্ধন শেষে কত দিন পর দলিল সরবরাহ করা হবে, সে সম্পর্কে সাব-রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দেওয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে জমির ক্রেতাকে দলিল লেখকের ওপর নির্ভর করতে হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দলিল সরবরাহ করতে তিন মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় লেগে থাকে।
সাব-রেজিস্ট্রারেরা বলেন, নিবন্ধন শেষে তাৎক্ষণিক মূল দলিল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রতিটি অফিসে মাসে গড়ে এক হাজারের বেশি দলিলের নকল তৈরি করতে হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে মূল দলিল সংগ্রহ করতে এসে জমির মালিকদের আবারও হয়রানির শিকার হতে হবে এবং গুনতে হবে বাড়তি টাকা।

0 comments:

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More